শুক্রবার, ১৫ নভেম্বর ২০২৪, ১২:১১ পূর্বাহ্ন
এ্যাডভোকেট সিরাজ প্রামাণিক: কৃষক হাকিম মিয়ার পুরো পরিবার কৃষির উপর নির্ভরশীল। এমতাবস্থায় তার মেয়ের বিয়েতে কিছু টাকার প্রয়োজন দেখা দিলে একখন্ড জমি বিক্রয়ের ঘোষনা দেন। তাঁরই প্রতিবেশী আরেক কৃষক মন্টু মিয়া জমিটি ক্রয়ে সন্মত হন। ফলে উভয়ের মধ্যে একটি চুক্তিনামা স্বাক্ষরিত হয়। কিন্তু হাকিম মিয়ার মেয়ের বিয়ের পর জমিটি মন্টু মিয়ার বরাবর রেজিষ্টি করে দিতে অস্বীকৃতি জানান। অবশেষে বিষয়টি আদালতে গিয়ে পৌঁছায়।
বেচেঁ থাকা কিংবা প্রয়োজনের তাগিদে কখনে কখনো জমি ক্রয়-বিক্রয় করত হয়। এই জমি ক্রয় বা বিক্রয় নির্দিষ্ট পদ্ধতিতে করতে হয়। আমাদের দেশের লোকজন কোনো জমি ক্রয় বা বিক্রয়ের ক্ষেত্রে প্রায়ই প্রতারণার শিকার হয়ে আসছেন। নির্দিষ্ট আইন অনুযায়ী জমি ক্রয় বা বিক্রয় না করার অজ্ঞতাই এর জন্য দায়ী। এছাড়া প্রভাবশালী ভূমি মালিকদের অসৎ উদ্দেশ্যের কারণে নির্দিষ্ট আইনের ফাঁক ফোঁকরে জমি ক্রয়-বিক্রয় সম্পন্ন হওয়ার ক্ষেত্রে নিরক্ষর জনগণ প্রতারিত হন। কেউ যদি কোন জমি ক্রয় করতে চান তা হলে জমি বাবদ সমমূল্যের কিছু অংশ ক্রেতার কাছ থেকে আদায় করে প্রাথমিক পর্যায়ে বায়নাপত্র অনুযায়ী নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে পুরো মূল্য পরিশোধ করে ক্রেতাকে বিক্রেতার কাছ থেকে একটি দলিল সম্পাদন করিয়ে নিতে হয়। আর এই দলিলই ক্রেতার মালিকানা প্রমাণ করে। কিন্তু বায়নাপত্রের চুক্তি মোতাবেক দলিল সম্পাদন করতে কোনো পক্ষ অস্বীকার করলে বা টালবাহানা করলে এর বিরুদ্ধে নির্দিষ্ট আইন অনুযায়ী প্রতিকার পাওয়া সম্ভব।
এ ধরণের প্রতিকার দেওয়ানি প্রকৃতির মোকদ্দমা এবং এর মাধ্যমে প্রতিপক্ষকে দলিল সম্পাদনের জন্য বাধ্য করা যায়। সুনির্দিষ্ট প্রতিকার আইনের ১২ ধারা অনুযায়ী, কোনো চুক্তির সুনির্দিষ্ট কার্যসম্পাদন আদালতের ইচ্ছাধীন ক্ষমতা বলে আদায় করা যেতে পারে, যদি সম্মতিভূক্ত কার্যসম্পাদন না করলে যে ক্ষতি হবে তা নির্ণয়ের কোনো মানদন্ড না থাকে, যদি চুক্তিভূক্ত কাজ এমন হয় যে তা সম্পাদন না করলে আর্থিক ক্ষতিপূরণের মাধ্যমে পর্যাপ্ত প্রতিকার লাভ করা যায় না এবং চুক্তি সম্পাদন না করলে আর্থিক ক্ষতিপূরণ পাওয়া যাবে না। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রে দলিল সম্পন্ন না হওয়ার জন্য অনেকেই প্রতিকার থেকে বঞ্চিত হন। এ ক্ষেত্রে কোনো আইনজীবীর মাধ্যমে নির্দিষ্ট এখতিয়ারসম্পন্ন আদালতে মোকদ্দমা দায়ের করা যায়। তবে এ ক্ষেত্রে তামাদি আইন মোতাবেক, বায়নাপত্র অনুযায়ী চুক্তির সময় থেকে নির্দিষ্ট দিনের মধ্যে মামলা দায়ের করতে না পারলে ক্ষতিগ্রস্থ পক্ষ প্রতিকার হতে বঞ্চিত হবেন।
বাংলাদেশে এ ধরণের মোকদ্দমা অহরহ হচ্ছে। এ ধরণের মামলাকে মূলত চুক্তি প্রবলে কবলা পাওয়ার মোকদ্দমা বলা হয়। এ ধরণের মোকদ্দমার ক্ষেত্রে বাদী পক্ষকে তামাদি আইন মোতাবেক নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে নির্দিষ্ট এখতিয়ারসম্পন্ন আদালতে আবেদন করতে হবে। আইনজীবীর মাধ্যমে মামলার মূল কারণ, বাদী ও বিবাদীর নাম-ঠিকানাসহ স্পষ্টভাবে আরজিতে উপস্থাপন করতে হবে। আরজিতে মামলার ‘কজ অব অ্যাকশন’ (মামলার কারণ) সহ প্রার্থনা অংশে কবলা দলিল সম্পাদন ও রেজিষ্ট্রি করার আদেশসহ ক্ষতিপূরণ এবং বাদী বরাবর ডিক্রি দিতে স্পষ্টভাবে উল্লেখ করে সত্যপাঠ দিতে হবে যা আইনজীবীই সম্পন্ন করবেন। এ ধরণের মামলায় অ্যাড-ভ্যালোরেম কোর্ট ফি প্রদান করতে হয়। বর্তমানে সুনির্দিষ্ট প্রতিকার (সংশোধন) আইন, ২০০৪ অনুযায়ী, বায়নাপত্র রেজিস্ট্রি করা বাধ্যবাধকতামূলক। রেজিস্ট্রিবিহীন বায়নাপত্র হলে এ ধরণের মোকদ্দমায় দলিল সম্পাদনের প্রতিকার চাওয়া যাবে না। তবে ২০০৬-এর জুন মাস পর্যন্ত পূর্বে সম্পন্ন রেজিস্ট্রিবিহীন বায়নাপত্রের চুক্তি অনুযায়ী মামলা করার সময় ছিল। ২০০৬-এর ১ জুলাই থেকে নতুন সংশোধনটি কার্যকর হয়েছে এবং পূর্বের সব বায়নাপত্র (রেজিস্ট্রিবিহীন) অকার্যকর হয়ে পড়েছে। বর্তমানে তামাদির সময় সীমার ক্ষেত্রে তামাদি (সংশোধন) আইন, ২০০৪-এর ২৮ নম্বর আইন অনুযায়ী, বায়না সম্পাদনের অস্বীকৃতি যেদিন করা হবে, সেদিন থেকে এবং এক বছরের মধ্যে মোকদ্দমা দায়ের করতে হবে।
উপরের গল্পের হাকিম মিয়ার সাথে মন্টু মিয়ার শুধু একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। কিন্তু চুক্তিটি বায়নামা আকারে রেজিষ্ট্রি হয়নি। ফলে মন্টু মিয়া সুনির্দিষ্ট প্রতিকার আইনের ১২ ধারা অনুযায়ী আদালতে কোনো প্রতিকার পাওয়ার যোগ্য নয়। অবশেষে মন্টু মিয়া প্রতারণার অভিযোগ এনে হাকিম মিয়ার বিরুদ্ধে ফৌজদারী কার্যবিধি আইনের ৪২০ ধারায় মামলা দায়ের করে প্রতিকার পান।
লেখক: বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্টের আইনজীবী, আইন গ্রন্থ প্রণেতা ও সম্পাদক দৈনিক ‘ইন্টারন্যাশনাল’। Email:seraj.pramanik@gmail.com, মোবাইল: ০১৭১৬-৮৫৬৭২৮